ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিস্থিতি রবিবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও মিয়ানমারের রাখাইনে ব্যাপক সংঘর্ষ অব্যাহত থাকায় টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনের মধ্যে পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
তবে নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে এখন আর কোন যুদ্ধজাহাজ দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
যদিও সেন্ট মার্টিন নিয়ে শনিবার সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের মন্তব্যের পর সেন্ট মার্টিন পরিস্থিতি নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে অনেকের মধ্যেই।
তারা দুজনই ‘আক্রান্ত হলে' বা 'সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হলে’ সমুচিত জবাব দেয়ার কথা বলেছেন।
চলমান এই সংকটের মধ্যেই সেন্ট মার্টিন ঘুরে এসেছেন বর্ডার গার্ড প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।
এদিকে দ্বীপের স্থানীয়রা বলছেন, বড় জাহাজে করে প্রশাসনের উদ্যোগে দরকারি মালামাল দ্বীপটিতে আসলেও অনেক দিন ধরে নিয়মিত পণ্য সরবরাহ না থাকায় প্রায় দশ হাজার অধিবাসীর দ্বীপটিতে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে।
মূলত পাঁচই জুন থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশী নৌযানে গুলি লাগার ঘটনার পর থেকেই নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছে প্রশাসন।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আদনান চৌধুরী বিবিসিকে বলছেন, "পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নৌযান চলাচল শুরু হবে।"
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের পর্যটনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো সেন্ট মার্টিন। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় এ দ্বীপটি অবস্থিত। এই নাফ নদীর পূর্ব অংশ মিয়ানমারে আর পশ্চিম অংশ বাংলাদেশে পড়েছে।
মিয়ানমারের দিক থেকে গুলি, সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা সংকটে
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ যেভাবে বাংলাদেশের অংশ হলো
বাংলাদেশের যে স্থানগুলো পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়
ছবির উৎস, Rahmat Ullah
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে একটি ইউনিয়ন এবং সেখানে এখন প্রায় দশ হাজার মানুষ বসবাস করে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক পর্যটক প্রতি বছর এই দ্বীপ ভ্রমণে যায়।
তবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বাংলাদেশের জলসীমার মধ্য দিয়ে যেতে হলেও কিছু জায়গা আছে যা মিয়ানমার সীমান্তের খুব কাছাকাছি।
ওবায়দুল কাদের এবং সেনাপ্রধান যা বলেছেন
শনিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে সেন্ট মার্টিন ইস্যুটি নিয়ে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তাকে উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা বাসস সংবাদ পরিবেশন করেছে।
বাসসের খবর অনুযায়ী এক প্রশ্নের জবাবে মি. কাদের বলেন, “নিজেদের এত খাটো করে দেখব কেন? আমরাও প্রস্তুত। আক্রমণ করব না, কিন্তু আক্রান্ত হলে কি ছেড়ে দেব? আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে হবে।”
“মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও বৈরিতা নেই। আলাপ-আলোচনার দরজা খোলা আছে। আমরা কথা বলতে পারি।
যতক্ষণ কথা বলা যাবে, আলাপ-আলোচনা করা যাবে। আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি এবং করে যাব। আমাদের যেন কোনও উস্কানি না থাকে,” বলেন তিনি।
অন্যদিকে, একই দিনে শরিয়তপুরের জাজিরায় শেখ রাসেল সেনানিবাসে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “কেউ যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায় বা কোন কারণে আমাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হলে তো আমরা ছেড়ে দিবো না।”
তিনি বলেন, দেশে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে সেটি তার প্রতিহত করবেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বর্ডারে বর্ডার গার্ড আছে কোস্ট গার্ড আছে। তারা সম্পূর্ণ তদারকি করছে।
“সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা প্রস্তুত আছি। এর চেয়ে লেভেল অন্য দিকে গেলে আমরা সমুচিত ব্যবস্থা নিবো। শুধু সেনাবাহিনী নয়, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী তারাও প্রস্তুত।”
“তবে এখন পর্যন্ত এমন কিছু হয়নি যে ডিফেন্স ফোর্সকে চলে যেতে হবে । ..... আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চাই। কেউ যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায় বা কোন কারণে আমাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হলে তো আমরা ছেড়ে দিবো না,” বলেন সেনাবাহিনী প্রধান।
মি. আহমেদ বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আছে। “কোস্ট গার্ড, বিজিবি দায়িত্ব পালন করছে। সবসময় আমাদের মধ্যে সমন্বয় আছে। আমরা যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবো।”
ছবির উৎস, RAHMAT ULLAH
এখন কী পরিস্থিতি?
ওবায়দুল কাদের ও সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্যের আগেই শনিবার নাফ নদীর মিয়ানমার অংশ থেকে এর আগের কয়েকদিন দৃশ্যমান থাকা কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ গভীর সাগরের দিকে সরে যায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আদনান চৌধুরী বলেছেন, এসব নৌযান গুলো নাফ নদী থেকে সরে সাগরের দিকে গেছে।
অন্যদিকে, মিয়ানমার সীমান্তে সংঘর্ষ ও বিস্ফোরণ এখনো বন্ধ হয়নি।
ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ইরাবতীতে শনিবার প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, ‘আরাকান আর্মি গত দু সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর দশটির বেশি ক্যাম্প দখল করেছে’।
সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সাথে লড়াইয়ে সামরিক জান্তার একজন কমান্ডার সহ দুইশোর মতো সৈন্য মারা গেছে বলে আরাকান আর্মিকে উদ্ধৃত করে বলেছে পত্রিকাটি।
ওই রিপোর্টে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যের অর্ধেকের বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন আরাকান আর্মির হাতে। এখন মংডু দখল নিয়ে লড়াই চলছে, যা বাংলাদেশের নিকটবর্তী।
বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো, রাখাইনের বেশ কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ হারানো সরকারি বাহিনী আবার চারদিক থেকে আরাকান আর্মিকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে।
সে কারণেই কয়েকদিন নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ অবস্থান নিয়েছিলো।
ছবির উৎস, Getty Images
স্থানীয় সাংবাদিক রহমত উল্লাহ বিবিসিকে বলছেন, শনিবার গভীর রাতেও শাহপরীর দ্বীপ এলাকা থেকে প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেছে।
“কয়েক ঘণ্টা ধরে বিস্ফোরণ হয়েছে ওই অংশে। আমার বাড়ী শাহপরী থেকেও বেশ দূরে। কিন্তু আমিও শুনেছি শব্দ,” বলছিলেন তিনি।
তবে সেন্ট মার্টিন থেকে গত রাতে খুব একটা এমন শব্দ শোনা যায়নি বলে জানিয়েছেন দ্বীপের বাসিন্দা হাফেজ আহমেদ।
“আজ সেন্ট মার্টিন থেকে রোগী নিয়ে একটি স্পিডবোট টেকনাফে গেছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তবে সব জিনিসের দাম অনেক বেড়ে গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এর আগে পাঁচই জুন থেকে কয়েকটি বাংলাদেশী নৌযানে গুলির ঘটনার পর নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে দ্বীপটিতে পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
পাঁচই জুন সেন্ট মার্টিন থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি দল নির্বাচনে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি নিয়ে টেকনাফে ফেরার সময় তাদের নৌযানকে লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা ঘটে। সেদিন সন্ধ্যায় নাফ নদীতে বদরমোকাম এলাকার উল্টো দিক থেক এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়া হয়।
এরপর আটই জুন টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার সময় গুলির মুখে পড়ে একটি মালবাহী ট্রলার।
পরে ১১ই জুন সকালে স্পিডবোটে করে একজন রোগী নেয়ার সময় স্পিডবোট লক্ষ্য করে দশ রাউন্ডের মতো গুলি করা হয়, যার কয়েকটি স্পিডবোটেও লেগেছে।
এ পরিস্থিতিতে দ্বীপের মানুষের মালামাল পাঠানোর জন্য বড় জাহাজের ব্যবস্থা করে প্রশাসন।
কক্সবাজার থেকে সরাসরি সাগরপথে সেন্ট মার্টিনে শুক্রবার সেই জাহাজে করে মালামাল পৌঁছে দেয়া হয়।